খুজুঁন

চোখ রাঙ্গানো করোনার গতিবিধি


বিশ্বের ১৮৮টি দেশে করোনাভাইরাস তার বিস্তার ঘটিয়েছে। শনাক্ত রোগীর সংখ্যা আট কোটি ছাড়িয়েছে। করোনায় মৃতের সংখ্যা সাড়ে ১৭ লাখ। জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটি এবং ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্য অনুযায়ী, সাড়ে পাঁচ কোটির বেশি লোক করোনা থেকে সেরে উঠেছেন। তবে তাদের বেশির ভাগই করোনাপরবর্তী জটিল সমস্যায় ভুগছেন। বিশেষ করে যেসব রোগী হাসপাতালের আইসিইউ থেকে ফিরেছেন, তারা ফুসফুস, হার্ট, কিডনি এবং ডায়াবেটিসজনিত ভয়াবহ সমস্যা মোকাবেলা করছেন।

বিশ্বে করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে করোনা রোগীর সংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে গেছে। মারা গেছে প্রায় তিন লাখ ৪০ হাজার মানুষ। ভারতে করোনা রোগীর সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে। মারা গেছে দেড় লাখ মানুষ। ব্রাজিলে করোনা রোগীর সংখ্যা ৮০ লাখ ছাড়িয়েছে। মৃত্যু দুই লাখ ছুঁইছুঁই। করোনা রোগী ও মৃত্যু নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে যুক্তরাজ্য, মেক্সিকো, রাশিয়া, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত প্রভৃতি দেশ।

বাংলাদেশে করোনা রোগীর সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে। মারা গেছেন সাড়ে সাত হাজার মানুষ। এর বাইরে করোনার উপসর্গে মারা গেছেন আরো দুই হাজারের বেশি। করোনায় বাংলাদেশে ১১৬ জন ডাক্তারের মৃত্যু হয়েছে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। চীনে করোনায় প্রথম রোগীর মৃত্যু হয় ২০২০-এর ৯ জানুয়ারি। এর ঘোষণা আসে ১১ জানুয়ারি। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিষয়ে প্রথম সতর্ক করার চেষ্টা করেন একজন চীনা ডাক্তার, যিনি চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে উহানের একটি হাসপাতালে কাজ করতেন। নাম লি ওয়েনলিয়াং। দুঃখজনক হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত তিনিও করোনাভাইরাসে মারা যান। এ ভাইরাসের কথা প্রকাশ করায় তাকে চীনা সরকার কড়া নজরদারিতেও রেখেছিল। চীনের বাইরে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন থাইল্যান্ডে গত ১১ জানুয়ারি। তবে থাইল্যান্ড কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করায় সেখানে করোনাভাইরাস থাবা তেমন বিস্তার করতে পারেনি। করোনায় চীনের বাইরে প্রথম কোনো রোগী মারা যান ফিলিপাইনে গত ২ ফেব্রুয়ারি। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৩০ জানুয়ারি বিশ্বে স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি করে। ১১ ফেব্রুয়ারি করোনাভাইরাস থেকে রোগের নামকরণ করা হয় ‘কোভিড-১৯’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় গত ১১ মার্চ করোনাভাইরাসকে ‘বৈশ্বিক মহামারী’ রূপে ঘোষণা করে।

করোনার নতুন রূপধারণ: ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও মানবদেহে তার প্রয়োগ শুরু হওয়ার পর পৃথিবীর মানুষ যে মুহূর্তে নতুন আশায় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, সে সময় করোনাভাইরাসের নতুন রূপ বদলের (স্ট্রেইন) খবরে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। নতুন বৈশিষ্ট্যের এক করোনাভাইরাস লন্ডন এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডে দ্রুত ছড়াচ্ছে বলে জানান ব্রিটিশ স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। তারা সেটিকে নিউ ভ্যারিয়েন্ট, অর্থাৎ নতুন বৈশিষ্ট্যের ভাইরাস বলে বর্ণনা করেন। এই নতুন ভাইরাস ৭০ শতাংশ বেশি হারে ছড়াচ্ছে। এ ঘটনায় যুক্তরাজ্যের সাথে ৪০টিরও বেশি দেশ বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে।

নতুন বৈশিষ্ট্যের করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার খবর শেষ হতে না হতেই আরো একটি নতুন করোনাভাইরাস বিস্তারের খবর আসে। এর উৎসস্থল দক্ষিণ আফ্রিকা। সে দেশের বিজ্ঞানীরা জানান, ভাইরাসের এই ভ্যারিয়ান্টটিও ‘দ্রুত ছড়ায়’। দুই ভাইরাসেরই একটি নির্দিষ্ট অংশে এন ফাইভ জিরো ওয়ান ওয়াই (N501y) নামে পরিবর্তন হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা জানান। ওই অংশ দিয়ে মানুষের দেহের কোষকে আক্রান্ত করে ভাইরাসগুলো। নতুন এই করোনাভাইরাস বিভিন্ন দেশে ছড়িয়েছে। সিঙ্গাপুর এবং বাংলাদেশেও এই নতুন ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলে খবরে বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফাউসি বলেছেন, করোনার নতুন ধরনটি ইতোমধ্যে হয়তো আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, গত বছরের ডিসেম্বরের চীনের উহানে প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর করোনাভাইরাস এ পর্যন্ত ১৭ বার জোরালোভাবে মিউটেশনের মাধ্যমে নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলেছে।

টিকা ও নতুন বছরের আশাবাদ: বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি ব্যক্তিত্ব, মাইক্রোসফট সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস তার লেখায় ২০২১ সালকে ‘একটি আশাবাদের বছর’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, নতুন বছরটি আগের বছরের চেয়ে ভালো হবে। কারণ কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পুরো বিশ্ব একজোট হয়েছে। বিশ্বের সরকার ও কোম্পানিগুলো এবং বিজ্ঞানীরা একজোট হয়ে মহামারী অবসানে কাজ করছেন। ফাইজার ও বায়োএনটেকের তৈরি করা টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। মডার্নার টিকা ৯৪ শতাংশ এবং অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রজেনেফার টিকা ৭০ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণিত। জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা নিয়েও বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। ২০২১ সালে করোনার টিকা ও চিকিৎসার অগ্রগতির ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছবে যে, এর বৈশ্বিক প্রভাব জোরদার হতে থাকবে। এই টিকা সর্বত্র পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত জীবন বাঁচাতে মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এর মধ্য দিয়ে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার গতি কমিয়ে দেয়া সম্ভব।

হতাশার খবরও আছে। করোনাভাইরাসের টিকা ধনী দেশগুলো তাদের নাগরিকদের জন্য একচেটিয়া কিনে নিচ্ছে। আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো তিনগুণ টিকা কিনে রেখেছে; কানাডা কিনে রেখেছে চারগুণ। গরিব ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো এ ক্ষেত্রে অসহায়। জাতিসঙ্ঘ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ব্যাপারে এগিয়ে না এলে টিকা থেকে এসব দেশ বঞ্চিতই থেকে যাবে। মহামারী দমন করতে সমন্বিত কর্মসূচি নিতে হবে। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতে, মানুষের জীবনকে ওষুধ কোম্পানিগুলোর মুনাফার ওপরে স্থান দিতে হবে। পৃথিবীর সব প্রান্তে স্বল্পতম সময়ে ও খরচে কোভিড টিকা পৌঁছে দিতে হবে। নতুবা মহামারী দমন করা যাবে না।’

No comments

Theme images by lobaaaato. Powered by Blogger.